‘৩০ সেকেন্ডে উল্টে যায় লঞ্চটি, আমার বন্ধু উঠতে পারেনি’

আসাদুজ্জামান, ঢাকা

আপডেট: ২৯ জুন ২০২০, ১৮:৫৭
মুন্সিগঞ্জের সত্যরঞ্জন বণিক আর আবদুর রউফ দুই বন্ধু। ২০ বছর ধরে রোজ লঞ্চের যাত্রী হয়ে সকালে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। কাজ শেষে আবার ঢাকা থেকে বিকেলে মুন্সিগঞ্জে চলে যান। প্রতিদিনের মতো আজও সকাল সাড়ে সাতটায় মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটিতে দুই বন্ধু ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট টারমিনালের কাছাকাছি চলে আসে। লঞ্চটি তখন ঘাট থেকে ২০০ হাত দূরে ছিল। লঞ্চের যাত্রীরা নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক তখন সদরঘাটের একটি লঞ্চ পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চটি তলিয়ে যায়।
নিহত সত্য রঞ্জন বণিক। ছবি: সংগৃহীতনিহত সত্য রঞ্জন বণিক। ছবি: সংগৃহীতআবদুর রউফের বন্ধু সত্যরঞ্জন মারা গেছেন। ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন রউফ। কীভাবে লঞ্চটি ডুবে গেল, সে ব্যাপারে আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লঞ্চটি সদরঘাটের একেবার কাছে চলে আসে। আমরা নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ঘাটের খালি একটি লঞ্চ আমাদের লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়। ভয়ে আমরা সবাই চিৎকার দিই। ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের লঞ্চটি উল্টে যায়। আমরা ছিলাম লঞ্চের নিচের তলায়। পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকি। দম আমার বের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি পানির ওপরে উঠতে পারি। বেঁচে যাই। কিন্তু আমার বন্ধু সত্যরঞ্জন উঠতে পারেনি, সে মারা গেছে।’
আবেগাপ্লুত আবদুর রউফ জানান, লঞ্চের যারা মারা গেছেন বা ডুবে গেছেন, তাঁদের অনেককে তিনি ভালো করে চেনেন। কারণ এসব মানুষ মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আসেন। কাজ শেষে আবার মুন্সিগঞ্জে চলে যান।’ আবদুর রউফ বলেন, ‘আমাদের লঞ্চটতে ৫০ থেকে ৬০ জন যাত্রী ছিল। নিয়ম মেনে ঘাটে ভেড়াচ্ছিল। হঠাৎ করে অন্য লঞ্চটি ধাক্কা দিয়ে এই মানুষগুলোকে মেরে ফেলল। আমিও মরে যেতে পারতাম।’
সত্যরঞ্জনের বড় মেয়ে দোলা বণিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবার মিটফোর্ডে দোকান আছে। আমি থাকি ঢাকায়। আমার বাবা প্রতিদিন মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। আবার কাজ শেষে চলে যান। গত পরশু দিন আমার বাবা আমার বাসায় আসেন। আমি বাবাকে বলি, বাবা, এখন করোনা ভাইরাস। তুমি লঞ্চে করে যাতায়াত কোরো না। আমার বাসায় থেকে ব্যবসা করো। কিন্তু আমার বাবা কথা শুনল না। চলে গেল।’
মিটফোর্ডে স্বজনদের কান্না
ফল ব্যবসায়ী আবু সাঈদ মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকার সদরঘাটের বাদামতলী থেকে ফল কেনার জন্য বাসা থেকে সকাল ৭টায় রওনা হন। পরে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে লঞ্চে ওঠেন। আবু সাঈদের কোনো খবর পাচ্ছেন না তাঁর স্বজনেরা। আবু সাঈদের স্ত্রী নূর জাহান বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভাবের সংসার। করোনায় অনেক দিন ফলের দোকান বন্ধ। আয় নেই। এখন আবার ব্যবসা শুরু হয়েছে। আমার স্বামী ফল কেনার জন্য ঢাকায় আসেন। সকাল সকাল লঞ্চ ধরতে হবে বলে খেয়েও আসেননি।’
আবু সাঈদের স্ত্রী নূর জাহান মিটফোর্ডে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছবি: আসাদুজ্জামানআবু সাঈদের স্ত্রী নূর জাহান মিটফোর্ডে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছবি: আসাদুজ্জামানএই কথা বলেই কেঁদে ফেলেন নূর জাহান। লঞ্চ দুর্ঘটনায় উদ্ধার করা সব লাশ রাখা হয়েছে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। স্বজন হারানোর বেদনায় মিটফোর্ডের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বেলা একটার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘২৫টি লাশ (এখন পর্যন্ত ৩১) আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। আরও লাশের সন্ধান আমরা করছি।’ কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল, সে ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, তদন্ত কমিটি করা হবে। তখন পুরো চিত্র জানা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.