মা-বোনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রিফাত
৩০ জুন ২০২০, ০০:০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রিফাত (২৬) পুরান ঢাকার কামালবাগের একটি জুতার দোকানে কাজ করেন। গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ মীরকাদিমের কাঠপট্টি এলাকায়। বাড়িতে মা আর ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া বোন মুক্তা থাকেন। জমি বিক্রি করে বাবা মালেক শেখ মাস ছয়েক আগে মালয়েশিয়া গেছেন।
এখনও সংসারের জন্য টাকা পাঠাতে পারেননি। মা-বোনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে রিফাত প্রতিদিন মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। কাজ শেষে আবার বাড়ি ফিরে যান। সম্প্রতি তিনি পুরান ঢাকায় একটি বাসা ভাড়া নেন। মা আর বোনকে নিয়ে সেই বাসার উদ্দেশেই রওনা দিয়েছিলেন রিফাত। কিন্তু সেই বাসায় আর ওঠা হল না। একটি দুর্ঘটনা তার স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে।
বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবিতে তার মা ও বোনের মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় বেঁচে গেলেও রিফাতের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করছে। তিনি বলেন, ‘মা-বাবা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছেন। মা-বোনকে একটু ভালো রাখার মাধ্যমে সেই ঋণ শোধ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর পারলাম না। এখন বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।’
পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে (মিটফোর্ড) মা আর বোনের লাশ দেখে মূর্ছা যাচ্ছিলেন রিফাত। কেবল রিফাত নন, স্বজনদের লাশ নিয়ে বিলাপ করছিলেন অনেকেই। তাদের আহাজারি আর বুকফাটা কান্নায় শ্যামবাজার-সদরঘাট-মিটফোর্ড এলাকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। পাগলপ্রায় স্বজনদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা ছিল না অনেকের। এখনও স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন কেউ কেউ। দিনব্যাপী শোকের মাতাম চলে গোটা এলাকায়।
লঞ্চডুবিতে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩২ জনের লাশ উদ্ধার করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়া হয়। সুরতহাল শেষে তাদের লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়। যারা মারা গেছেন, তাদের মধ্যে নারী, শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক রয়েছেন। সবার বাড়িই মুন্সিগঞ্জে। একই পরিবারের একাধিক সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।
স্বামীকে ডাক্তার দেখাতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন স্ত্রী। ডাক্তার দেখাতে এসে প্রাণ গেছে দুই বছরের শিশুসহ একই পরিবারের তিনজনের। স্বামীর চোখের অপারেশন করাতে এসে প্রাণ হারিয়েছেন স্ত্রী। ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন স্বামী। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসা করাতে এসে প্রাণ গেছে শিশুসহ তিনজনের।
মা ও বোনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় রিফাত : মা ময়না বেগম এবং ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া বোন মুক্তা বেগমকে হারিয়ে মীরকাদিম কাঠপট্টি এলাকার রিফাতের অবস্থা পাগলপ্রায়। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রিফাত বলেন, লঞ্চের ভেতর আমি এবং মা দুই পাশে বসেছিলাম। বোন ছিল মাঝখানে।
হঠাৎ লঞ্চ কাত হয়ে দ্রুত ডুবতে থাকে। এ সময় আমি লাফ দিয়ে লঞ্চ থেকে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু মা-বোন লাফ দিতে পারেননি। তারা ডুবে যায়। লাফ দেয়ার কারণে আমি পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হই। পরে আমাকে উদ্ধার করে স্থানীয় ন্যাশনাল হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে আমি হাসপাতালে এসে মা-বোনের নিথর দেহ দেখতে পাই।
স্ত্রী-ছেলে-খালু শ্বশুরকে হারিয়ে জাকিরের আর্তনাত : গ্রামের বাড়িতে ফেরি করে কাপড় বিক্রি করেন জাকির হোসেন শেখ। তিনি হারিয়েছেন স্ত্রী সুমনা আক্তার (৩৩), ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত ১২ বছরের শিশু মাদ্রাসাছাত্র তামিম এবং তার খালু শ্বশুর গোলাপ হোসেন ভূঁইয়াকে। অর্তনাত করতে করতে জাকির বলেন, আমি গরির মানুষ। ফেরি করে কাপর বিক্রি করে সংসার চলে।
সম্প্রতি আমার ছেলে তামিমের ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে। ওর চিকিৎসার জন্য আমার স্ত্রী ও খালুশ্বশুর সকালে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। টেলিভিশনে লঞ্চডুবির খবর পেয়ে স্ত্রী ও খালুশ্বশুরের মোবাইলে বারবার ফোন দিই।
কিন্তু কেউ ফোন ধরছিল না। তাই দ্রুত সদরঘাটে আসি। সেখান থেকে হাসপাতাল মর্গে এসে তাদের লাশ শনাক্ত করি। তিনি বলেন, আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব?
স্বামীকে ডাক্তার দেখাতে এসে প্রাণ দিলেন বিউটি : স্ত্রী বিউটি বেগমকে (৩৮) হারিয়ে মিটফোর্ট মর্গের সামনে বিলাপ করছিলেন স্বামী লিটন খান। তিনি বলেন, আমার চোখে সমস্যা ছিল। ডাক্তার অপারেশন করাতে বললেও আমি তা করাতে চাচ্ছিলাম না। অনেক বুঝিয়ে বিউটি আমাকে রাজি করিয়েছে। বলেছে, তোমর সুস্থতার ওপর পুরো পরিবার নির্ভর করে।
তোমার নিজের জন্য না হলেও আমাদের জন্য হলেও চোখের অপারেশনটা করাও। শেষ পর্যন্ত তার কথায় রাজি হয়ে তার সঙ্গে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিই। লঞ্চডুবির ঘটনায় আমি আহত হয়ে বেঁচে গেলেও স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলাম না।
বোন-ভাগ্নে-দুলাভাইয়ের লাশের অপেক্ষায় সুমন : মর্গের সমানে লাশের জন্য অপেক্ষায় থাকা মো. সুমন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বোন মারুফা (২৫) অসুস্থ ছিলেন। চিকিৎসার জন্য তিনি দুই বছরের ছেলে তালহা এবং দুলাভাই (অন্য বোনের জামাই) মো. আলম ঢাকায় লঞ্চযোগে আসছিলেন। কিন্তু তাদের লঞ্চটি লালকুঠি ঘাটে ভিড়ার আগেই অপর একটি বড় লঞ্চের ধাক্কায় পানিতে ডুবে যায়। এতে তিনজনেরই মৃত্যু হয়েছে।
স্ত্রী-ছেলের লাশ মিললেও পাওয়া যাচ্ছে না রহমানকে : ঢাকা জজকোর্টের মোহরি আবদুর রহমান, ছেলে রিফাত এবং স্ত্রী হাসিনা রহমান মুন্সিগঞ্জ থেকে একসঙ্গে ঢাকায় আসছিলেন। তাদের মধ্যে মা-ছেলের লাশ পাওয়া গেলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত আবদুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নেই সুমনের : সুমন ব্যাপরী সদরঘাটে ফলের ব্যবসা করতেন। ঢাকায় মেসে থাকতেন। মাঝেমধ্যে বাড়ি যেতেন। দুদিন আগে গ্রামে যান। সোমবার লঞ্চে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। এখনও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে লাশের অপেক্ষায় ছিলেন তার বড় ভাই শাহীন এবং চাচাতো ভাই হাবিবসহ বেশ কয়েকজন। সুমনের ভাই শাহীন জানান, সকালে লঞ্চডুবির খবর পাওয়ার পরই লঞ্চ ভাড়া করে ঘটনাস্থলে ভাইয়ের লাশ খুঁজেছি। হাসপাতাল মর্গে এসে খুঁজেছি। কিন্তু সুমনের লাশ পাচ্ছি না।
দুই মামার খোঁজে মাসুদ : জীবিত উদ্ধার হওয়া যাত্রী মো. মাসুদ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ঘাটে ভেড়ার জন্য লঞ্চটি সোজা আসছিল। এ সময় অন্য একটা লঞ্চ বাঁকা হয়ে ঘাট থেকে রওনা দিচ্ছিল। আর ওই লঞ্চটা আমাদের লঞ্চের মাঝে ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের লঞ্চটা ডুবে যায়। আমি কেবিনে ছিলাম। গ্লাস খুলে আমি বের হই। ভেতরে আমার আপন দুই মামা ছিলেন।
তারা বের হতে পারেননি। মামার খোঁজে সদরঘাটের জেটিতে অবস্থান করা মাসুদ আরও জানান, ইসলামপুরের গুলশানআরা সিটিতে কাপড়ের ব্যবসা করেন তিনি। প্রতিদিন সকালে মুন্সিগঞ্জ থেকে এসে কাপড়ের দোকান করেন। রোববার ময়মনসিংহ থেকে তার দুই মামা তাদের মুন্সিগঞ্জের বাসায় বেড়াতে যান। তাদের নিয়ে লঞ্চের একটি কেবিনে করে ঢাকায় ফিরছিলেন তিনি। কিন্তু মামাদের আর বাড়ি ফেরা হল না।
No comments