মুন্সিগঞ্জের যুবক রিফাত আহমেদের বাবা থাকেন মালয়েশিয়ায়। মা ও ছোট বোনকে নিয়ে পুরান ঢাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। কিছুদিন আগে মা আর বোনকে নিয়ে ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জ সদরে নিজেদের বাসায় বেড়াতে যান, যা এখন শুধুই স্মৃতি।
সোমবার সকাল ৮টার দিকে মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন রিফাত। লঞ্চে ছিলেন তাঁর মা ময়না বেগম, বোন মুক্তা আক্তার আর বন্ধু রিপন। সোয়া ৯টার সময় লঞ্চটি যখন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের কাছে আসে, তখন হুইসেল বাজায়। রিফাত, তাঁর মা ও বোন ঘাটে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে পেছন থেকে ময়ূর-২ নামের লঞ্চটি ধাক্কা মারে। মুহূর্তের মধ্যে লঞ্চটি উল্টে বুড়িগঙ্গার পানিতে তলিয়ে যায়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যান রিফাত আহমেদ। কিন্তু তাঁর মা ময়না বেগম ও বোন মুক্তা আক্তার মারা যান। মা-বোন হারিয়ে পাগলপ্রায় এই যুবক।
কীভাবে বেঁচে গেলেন, সে সম্পর্কে রিফাত আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো কল্পনাও করিনি যে সদরঘাটে আমাদের লঞ্চকে অন্য আরেকটা লঞ্চ ধাক্কা দেবে। আমি, আমার মা আর বোন লঞ্চের ভেতরে ছিলাম। আর আমার বন্ধু ছিল ছাদে। মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে আমাদের লঞ্চ ছাড়ে ৮টার কিছু আগে। লঞ্চের ভেতর আমার হালকা ঘুম চলে এসেছিল। তবে সদরঘাটের কাছাকাছি আসায় আম্মু আমাকে জাগিয়ে তোলেন। আমরা সদরঘাটের একেবারই কাছাকাছি চলে আসি। তখন বড় একটা লঞ্চ আমাদের লঞ্চকে ধাক্কা মারে। সঙ্গে সঙ্গে উল্টে যায়। আমি, আমার মা আর বোন পানির নিচে তলিয়ে যাই। মা আর বোন পানির নিচে কোথায় হারিয়ে গেল জানি না। পানির নিচে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। কয়েক ঢোক পানিও খেয়েছি। কিন্তু কীভাবে যেন উপরে ভেসে উঠি। তখন আমার জ্ঞান ছিল না। লোকজন ধরাধরি করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমি বেঁচে যাই।’
রিফাত আহমেদকে বুড়িগঙ্গা থেকে উদ্ধার করে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসা দেওয়ার পর তাঁর জ্ঞান ফেরে। তখন রিফাত জানতে পারে তার পরম প্রিয় মা আর বোন বেঁচে নেই। তবে বন্ধু বেঁচে গেছেন। খবর পান লঞ্চ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া লাশগুলো সব নিয়ে রাখা হয়েছে পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন মা আর বোনের খোঁজে রিফাত স্বজনদের সহযোগিতায় আসেন মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে। সাদা কাফনে মোড়ানো লাশের সারি থেকে মা আর বোনকে খুঁজে বের করেন রিফাত। তখন রিফাতের কান্না আর আর্তচিৎকার সেখানে থাকা মানুষের হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায়।
রিফাত আহমেদ বলেন, ‘আমার আম্মু চাইতেন, আমি যেন ভালো একটা চাকরি করি। চাকরি করার পাশাপাশি আমি লেখাপড়াও করি। আমার বোনও লেখাপড়া করে। করোনার কারণে আমরা ঢাকা থেকে গ্রামে যাই। আমার আম্মু সব সময় বলতেন, “ভালো মানুষ হও।” আম্মুর কথার অবাধ্য কখনো আমি হইনি। এখন আমার আম্মু কোথায় হারিয়ে গেল। আমার বোন মুক্তা কোথায় হারিয়ে গেল। লঞ্চের খামখেয়ালির কারণে আজ আমি আমার মাকে হারালাম, বোনকে হারালাম। আমার মা আর বোন এখন কেবলই ছবি। আমার পরিবার যারা তছনছ করল, তাদের আমি কঠিন শাস্তি চাই।’
সদরঘাটের লঞ্চ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ছোট লঞ্চ মর্নিং বার্ডকে চাঁদপুর রুটের লঞ্চ ময়ূর-২ সোজা ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়। তখন মুহূর্তের মধ্যে মর্নিং বার্ড দুমড়েমুচড়ে ডুবে যায়।
চালকের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রিফাতের
মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ড নামের যে লঞ্চটি সদরঘাটে ডুবে গেল, সেটির চালকের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মা-বোন হারানো রিফাত আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমি সাক্ষী হতে চাই, যে চালক আজ মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি চালিয়েছেন, আদৌ তাঁর লঞ্চ চালানোর সনদ আছে কি না? কারণ মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসার পর মাঝপথে লঞ্চটি আরেকটি বালুবাহী জাহাজকে (বাল্কহেড) ধাক্কা দিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তখন কোনো দুর্ঘটনা হয়নি। তখন কিন্তু একবার আমরা ভয় পেয়ে যাই। আবার সদরঘাটের কাছাকাছি আসার পর আমাদের লঞ্চের চালক যদি সতর্ক থাকতেন, তাহলে কিন্তু এই দুর্ঘট না-ও ঘটতে পারত। তবে আমাদের লঞ্চটি ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার দায় ময়ূর-২ কোনোভাবে এড়াতে পারে না। ময়ূর-২ আমার মা-বোনকে মেরে ফেলল। আমি বিচার চাই। কঠিন শাস্তি চাই। এই ঘটনায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে, তাঁরা যেন জামিন না পান। দ্রুত বিচার করা হোক।’
মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ড নামের যে লঞ্চটি সদরঘাটে ডুবে গেল, সেটির চালকের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মা-বোন হারানো রিফাত আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমি সাক্ষী হতে চাই, যে চালক আজ মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি চালিয়েছেন, আদৌ তাঁর লঞ্চ চালানোর সনদ আছে কি না? কারণ মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসার পর মাঝপথে লঞ্চটি আরেকটি বালুবাহী জাহাজকে (বাল্কহেড) ধাক্কা দিয়েছিল। ভাগ্যক্রমে তখন কোনো দুর্ঘটনা হয়নি। তখন কিন্তু একবার আমরা ভয় পেয়ে যাই। আবার সদরঘাটের কাছাকাছি আসার পর আমাদের লঞ্চের চালক যদি সতর্ক থাকতেন, তাহলে কিন্তু এই দুর্ঘট না-ও ঘটতে পারত। তবে আমাদের লঞ্চটি ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার দায় ময়ূর-২ কোনোভাবে এড়াতে পারে না। ময়ূর-২ আমার মা-বোনকে মেরে ফেলল। আমি বিচার চাই। কঠিন শাস্তি চাই। এই ঘটনায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে, তাঁরা যেন জামিন না পান। দ্রুত বিচার করা হোক।’
ছোট লঞ্চ বন্ধ হোক
মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সব ছোট লঞ্চ চলাচল বন্ধ করার দাবি জানান রিফাত আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিতভাবে লঞ্চে করে ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জে যাই। আমরা জানি, ছোট লঞ্চগুলো যখন নদীতে চলে, তখন গ্রীন লাইনের মতো বড় বড় লঞ্চ যখন পাশ দিয়ে যায়, তখন ছোট লঞ্চগুলো দোলে। বহু ছোট লঞ্চ ডুবে বহু মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু বছরের পর বছর এই ছোট লঞ্চ চলছে। প্রশাসন এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। আমি চাই না, আমার মতো আর কেউ তার মা হারাক, কেউ বোন হারাক।’
সদরঘাটের লঞ্চ দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগ লোক মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা। লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে আসেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা মনছুর আহমেদ কালাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছরই মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে ছেড়ে আসা একাধিক লঞ্চ নদীতে ডুবে যায়। এই ছোট লঞ্চগুলোর চলাচল একেবারই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ নদীতে বড় বড় লঞ্চ চলে। এসব লঞ্চের কারণে ছোট লঞ্চে যাত্রীদের যাতায়াত অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। আমি মনে করি, বিআইডব্লিউটিএ যেন অতিসত্বর এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মিটফোর্ড মর্গে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ৩২টি লাশ আনা হয়।
মামলা, তিনজন গ্রেপ্তার, তদন্ত কমিটি
মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চ দুর্ঘটনায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক জয়নাল আবেদিনসহ কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেছে। নৌ-পুলিশ ইতিমধ্যে তিনজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। প্রথম আলোকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক। তিনি বলেন, ‘সদরঘাটের মর্নিং বার্ড লঞ্চ দুর্ঘটনায় ইতিমধ্যে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি কমিটি করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। আরেকটি তদন্ত কমিটি করেছি আমরা। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণে এখন পর্যন্ত জানতে পেরেছি, ময়ূর-২ নামের লঞ্চটি যাত্রী তোলার জন্য ঘাটে আসছিল। তখন ময়ূর-২-এর ধাক্কায় মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকার দিকে আসা ছোট আকৃতির লঞ্চ মর্নিং বার্ড ডুবে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইতিমধ্যে ময়ূর-২-এর লঞ্চের মালিকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সূত্রাপুর থানায় আমরা মামলা করেছি। তিনজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সদরঘাটের এই লঞ্চ দুর্ঘটনায় যাঁরা দায়ী, তাঁদের সবাইকে শাস্তির আওতায় আসতেই হবে। কেউই রেহাই পাবেন না।’
যেকোনো নৌ-দুর্ঘটনায় নৌপরিবহন অধ্যাদেশ অনুযায়ী মামলা হয়। এসব মামলার বিচার হয় নৌ-আদালতে। ২৫ বছর ধরে নৌ-আদালতে মামলা করে আসা আইনজীবী জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, নৌ-পরিবহন অধ্যাদেশ আইনে করা বেশ কয়েকটি মামলায় সাজা হয়েছে। তবে অধিকাংশ মামলার বিচার শেষ হতে অনেক বছর লেগে যায়। সাক্ষী আসেন না। রাষ্ট্রপক্ষ তৎপর হলে দ্রুত মামলার বিচার নিষ্পত্তি সম্ভব।
তবে নৌ–আদালতের প্রসিকিউটর পারভিন সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৌ-দুর্ঘটনার শতকরা ৯৫ ভাগ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে আসে। আমরা সব সময় তৎপর থাকি। তবে লঞ্চমালিকেরা প্রভাবশালী। অনেক মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লেগে যায়। তবে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। সদরঘাটের লঞ্চ দুর্ঘটনার মামলাটিও রাষ্ট্রপক্ষ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিচালনা করবেন।’
No comments